সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়। চরিত্রই হল তার
প্রকৃত বা আসল পরিচয়। মানুষের জীবনাচরণে ও চিন্তাধারায় যে ভাব পরিলক্ষিত হয়, তাই চরিত্র। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ
আছে- ‘ঞযব পৎড়হি ধহফ মষড়ৎু ড়ভ ষরভব রং পযধৎধপঃবৎ’ চরিত্র মানুষের মহার্ঘতম বস্তু। শ্রেষ্ঠতম অলংকার।
চরিত্র মানুষকে ন্যায়, সত্যসংযম ও শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষা দেয় এবং সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। মূলত: চরিত্র বলতে মানুষের
জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছুকেই বুঝায়। তবে সৎচরিত্রকে মানুষের অর্জন করতে হয়। এ অর্জন একদিকে সম্ভব নয়।
মানুষ তার জীবন প্রণালীর ধারাবাহিকতার মধ্যদিয়ে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত এটি অর্জন করে থাকে। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনো
সত্য থেকে স্খলিত হন না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না, ক্রোধে আত্মহারা হন না। কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না।
তিনি সব সময় মানুষকে ভালবাসার চোখে দেখেন। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সূত্র ধরেই শিশুর চরিত্র গঠিত হয়। মাতা-পিতা,
আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী স্কুলে সহপাঠি খেলার সাথীদের সাথে মিশে তার চরিত্রের রূপ বিকশিত হয়।
পারিপার্শ্বিক অবস্থায় মানবচরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যে যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে তার চরিত্র
সেভাবেই গঠিত হয়। এজন্য এসব ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। চরিত্র সাধনার ধন আর সংসার প্রলোভনময়।
পাপের হাজারো প্রলোভন মানুষকে বিপথে চালিত করতে সর্বদাই সচেষ্ট। আত্মসংযমের মধ্যদিয়ে সকল প্রলোভনকে দমন করে
আপনাকে সঠিক পথে চালানোর চেষ্টা করতে হয়। যার মনোবল দৃঢ় হয়, সে চরিত্র লাভের উপযোগী নয়। সে মানবসমাজে অধম। সভ্য
জগতে তার কোন স্থান নেই।
আমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনাচরণকে চরিত্র গঠনের সঠিক নমুনা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। হযরত মুহাম্মদ (সা.)
বলেছেন- ‘চারিত্রিক সৌন্দর্য ও গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।’ মানুষের চারিত্রিক পবিত্রতা
অর্জন করার ব্যাপারই ছিল মহানবী (সা.)-কে প্রেরণার মূল উদ্দেশ্য। গোটা বিশ্বের কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার কথা ও কাজ
দ্বারা উন্নত ও উত্তম চরিত্রসমূহের এক নমুনা তুলে ধরেছেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার বাস্তব জীবনের গুণাবলীকে আঁকড়ে
থাকার উপদেশ দান করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- রসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন,
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম।’ প্রত্যেক চরিত্রবান ব্যক্তির চরিত্রে একটি বিশেষ
ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। আর সেটাই হল চরিত্রের বলিষ্ঠতা।
তাদের অনমনীয় সেই ব্যক্তিত্ব দিয়ে চারপাশের বিপন্ন পরিবেশকে সুস্থ করে তুলেছেন। তাদের অদৃশ্য কর্মশক্তিতে মানব
জাতির মহাকল্যাণ সাধিত হয়। যার চরিত্র নেই তার কিছুই নেই। মানবসমাজে তার কোন স্থান নেই। বরং চরিত্রহীন ব্যক্তি
সমাজের ক্যানসার। কোনো মানুষ যদি সমাজে শ্রদ্ধাভাজন হয়, তা সে চরিত্রের জন্যই হয়ে থাকে। চরিত্রবান ব্যক্তি সত্য কথা
বলতে কোন ভয় পায় না। চরিত্রবান ব্যক্তি আত্মমর্যাদা ও জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে থাকেন। মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে
তিনি ভয় পান না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি প্রধানকে (যার উপাধি ছিল আশাজ্জ) সম্বোধন করে বলেছিলেন- ‘নিঃসন্দেহে
তোমার মধ্যে এমন দুটি প্রশংসনীয় সৌন্দর্য বিদ্যমান যা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়। একটি হল ব্যক্তিত্ব, আর দ্বিতীয়টি
হলো শিষ্টাচার।’ আমরা যদি সুন্দর জীবন-যাপন করতে চাই, তাহলে আমাদের উচিত চরিত্র ঠিক রাখার সাধনা করা। মানুষ সৃষ্টির
শ্রেষ্ঠ জীব। তাই মানুষের চরিত্র মানুষের মতই হওয়া উচিত। চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান। চরিত্র গঠনের গুরুত্ব এতই ব্যাপক
যে জীবনের যাবতীয় সফলতার পূর্বশর্ত হিসাবেই একে বিবেচনা করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে সুখী, সফল আত্মপ্রত্যয়ী এবং জয়ী
হওয়ার জন্য চরিত্রের প্রয়োজন। সামাজিক জীবনে প্রভাবশালী ও বরণীয় হওয়ার জন্য চরিত্রের প্রয়োজন। চরিত্রের প্রয়োজন
আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তিপূর্ণ বাসস্থান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য। ব্যক্তিগত সামাজিক ও
আন্তর্জাতিক জীবনে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চরিত্র অপরিহার্য।
চরিত্র দিয়েই মানুষকে মূল্যায়ন করা হয়। চরিত্রের স্থান বিদ্যারও ঊর্ধ্বে। চরিত্রবান ব্যক্তি সম্পদে হীন হলেও গৌরবে
মহান। চরিত্রহীন ব্যক্তির বিদ্যা, বুদ্ধি, ধন-সম্পদ যতই থাকুক না কেন, এসবের কোন মূল্য নেই। একজন চরিত্রবান মানুষের
জন্য সমাজের অনেক মানুষ উপকৃত হয়। শান্তিতে বাস করতে পারে। তেমনি একজন চরিত্রহীন মানুষ সমাজের অন্যসব মানুষের
সীমাহীন ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে নানারকম অপকর্মে মানুষের ক্ষতি করে থাকে। অর্থের বিনিময়ে চরিত্র হাটে-বাজারে
কিনতে পাওয়া যায় না। সাধনা দিয়ে এটাকে অর্জন করতে হয়। চরিত্র বলে বলীয়ান মানুষই পূর্ণ মনুষত্বের অধিকারী হয়।
চরিত্রবান ব্যক্তি জাতীয় শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
আমাদের সবারই চরিত্র গঠনের জন্য সাধনা করা দরকার। ভাল অভ্যাসগুলো আমাদের জীবনে স্থায়ী করার জন্য পুনঃ চেষ্টা করা
দরকার। আমাদের সন্তানরাও যেন সঠিক শিক্ষা পায়, ভাল পরিবেশে সৎসঙ্গ পায়, সঠিক চরিত্র গঠনের সাধনা করার প্রয়াস
পায়, আমাদের সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। চরিত্রবান বান্দা আল্লাহর কাছে উত্তম। এ কথাতো সবারই জানা। সুন্দর চরিত্র
মানুষের অমূল্য সম্পদ। চরিত্রকে পবিত্র রাখা একজন মানুষের অবশ্য কর্তব্য। চরিত্রহীন ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও দেশের
কলঙ্ক। চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষায় ইসলাম নানা নির্দেশনা দিয়েছে। যে সমাজে চারিত্রিক অধঃপতন শুরু হয় সেখানে বিভিন্ন
বালামুসিবত আসতে শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহ তাআলা বড় বড় যত শাস্তি মানুষকে দিয়েছেন, সেগুলোর কারণ ছিল
চারিত্রিক অধঃপতন ও অশ্লীলতার সয়লাব।
কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা হযরত লূত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের অশ্লীলতা, চারিত্রিক অধঃপতন ও তাদের ওপর নেমে
আসা ভয়াবহ শাস্তির কথা আলোচনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমি উক্ত
জনপদের উপরকে নিচে করে দিলাম এবং তার ওপর স্তরে স্তরে কাঁকর পাথর বর্ষণ করলাম।’ (সুরা হুদ : ৮২)। চরিত্রের
পবিত্রতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছে। যেসব কারণে মানুষের চারিত্রিক কলুষতা তৈরি হয়,
সেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও কেউ যদি অপকর্মে লিপ্ত হয় তাহলে তার কঠিন শাস্তির বিধান দিয়েছে। চরিত্র পবিত্রতা
রক্ষায় ইসলামের দিকনির্দেশনা নি¤œরূপ :
দৃষ্টি অবনত রাখা : নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টি সংযত রাখা। দৃষ্টিপাতের মাধ্যমেই সূত্রপাত হয় অনেক পাপাচারের। তাই নারী-
পুরুষ প্রত্যেকে নিজের দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত
রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত
আছেন। ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা
সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে।’
(সুরা নূর : ৩০-৩১)।
বেগানা নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত না হওয়া : বেগানা নারী-পুরুষ একান্ত নির্জনে একত্রিত হলে শয়তান তাদের ওপর
আক্রমণ করে কুকর্মে লিপ্ত করে। একাকী ঘরে পর্দার আড়ালে হলেও নির্জন বাস শরিয়তে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে নবী করীম
(সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো পুরুষ যেন কোনো বেগানা নারীর সঙ্গে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়কে
অশ্লীলতার জঘন্যতম গুনাহ’র কাজে লিপ্ত করবে। (মিশকাত শরিফ : ৩১৮৮)। অন্য হাদিসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে
বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘মাহরামের বিনা উপস্থিতিতে কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে না। এক ব্যক্তি
দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার স্ত্রী হজ্ব করার জন্য বেরিয়ে গেছে এবং অমুক অমুক জেহাদে অংশগ্রহণের জন্য
আমার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নবীজি বললেন, ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ্ব সম্পন্ন কর।’ (বুখারি :
৫২৩৩)।
কোমল কণ্ঠে কথা না বলা : নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আল্লাহ তাআলা একটা আকর্ষণবোধ সৃষ্টি করেছেন। এর কারণে
নারী-পুরুষ যখন পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে তখন উভয়ের মনে কুবাসনা জাগ্রত হয়। মোম যেমন আগুনের স্পর্শে এলে গলে যায়,
নারী-পুরুষ একত্রিত হলেও শয়তান তৃতীয়জন হয়ে তাদেরকে অশ্লীল কাজের প্রতি আহ্বান করে। এ জন্য আল্লাহ তাআলা নারী
ও পুরুষের মধ্যে পর্দার বিধান দিয়েছেন। পুরুষের সঙ্গে মোলায়েম কণ্ঠে কথা না বলা, দৃষ্টি অবনত রাখা, শরীরের সৌন্দর্য
প্রকাশ না করা ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ও আকর্ষণীয়
ভঙ্গিতে কথা বল না। ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে।’ (সুরা আহযাব : ৩২)।