ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত
‘আমাকে বাঁচান স্যার। না হলে গুলি করে মেরে ফেলেন। আমি বাইরে মুখ দেখাব কীভাবে। মা-বাবা
জানতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তখন আত্মহত্যা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ থাকবে
না।
ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় সিআইডি কার্যালয়ে বাঁচার এমন আকুতি এক
কলেজছাত্রীর। তবে এক বা দুজন নয়। এমন বহু তরুণীর কয়েক হাজার ভিডিওর খোঁজ পাওয়া
গেছে ‘পমপম’ নামের এক টেলিগ্রাম গ্রুপে।
যেভাবে ঘটনার শুরু : উত্তরা রাজউক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ছাত্রীর অভিযোগের সূত্র
ধরে পমপম-এর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। এতে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসে।
‘পমপম লিংকে’ বিভিন্ন ধরনের কয়েক হাজার গোপন ভিডিও পাওয়া যায়। এর মধ্যে ঢাকা কমার্স
কলেজ, সিটি কলেজ, রাজউক মডেল কলেজ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের একাধিক
শিক্ষার্থীর ভিডিও পাওয়া যায়। পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সচিব, ব্যবসায়ী কিংবা
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা-অনেকের সন্তানই ফেঁসে যায় পমপমের নিষিদ্ধ জগতে।
সিআইডি জানায়, এ ঘটনায় মামলা হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়। একপর্যায়ে পমপমের
অ্যাডমিন হিসাবে পরিচিত আবু সায়েম ওরফে মার্ক সাকারবার্গ নামের এক তরুণকে গ্রেফতার
করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে গ্রেফতার হন তার আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী। পমপমের
নিষিদ্ধ গ্রুপ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন তারা।
আবু সায়েমের দাবি-তিনি বেশির ভাগ ভিডিও-ছবি পেয়েছেন ভুক্তভোগীদের সাবেক প্রেমিক বা
বয়ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে। সম্পর্ক ভেঙে গেলে প্রতিশোধের জন্য গোপন ও ব্যক্তিগত অনেক কিছুই
তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে তিনি অর্থের বিনিময়ে সেগুলো দেখার জন্য অভিনব কৌশল
নেন। টেলিগ্রাম অ্যাপে পমপম নামের গ্রুপ খুলে আপলোড করেন ভিডিও ছবি।
লাখো গ্রাহক : একেকটি ভিডিও ক্লিপ নেট-দুনিয়ায় ত্বরিতবেগে ছড়িয়ে পড়ে। হুহু করে বাড়ে
পমপমের গ্রাহক সংখ্যা। শুধু অগ্রিম অর্থ পরিশোধকৃত (পেইড কনটেন্ট) গ্রাহকের সংখ্যা সাড়ে চার
লাখ ছাড়িয়ে যায়। রীতিমতো বিদেশি মুদ্রায় (রেমিট্যান্স) গ্রাহক হন ইউরোপ, আমেরিকা এবং
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের অনেকে। এছাড়া পমপম ফ্রি ভার্সনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে লাখো পর্ন আসক্ত
ব্যক্তি। সিআইডি বলছে, ভিডিও দেখে বেশ কয়েকজন তরুণীকে সিআইডি কার্যালয়ে ডাকা হয়। এ
সময় তাদের কয়েকজন কৌশলের আশ্রয় নেন। আপত্তিকর ভিডিও নিজের নয় বলে দাবি করেন
কয়েকজন। তবে এক তরুণীর মা ভিডিও দেখে তার মেয়েকে শনাক্ত করেন। তৎক্ষণাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে
তিনি মেয়েকে বেধড়ক পেটান। পরে ওই তরুণী ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বলেন।
পরিস্থিতি ভয়াবহ : দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের অনেকে স্বেচ্ছায় ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও ধারণ
করেন। আবার কেউ কৌতূহলবশত একান্তে নিজের স্পর্শকাতর অঙ্গের ভিডিও ধারণ করেন। পরে
প্রেমিক বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে ভিডিও ও ছবি শেয়ার করেন তারা। কিন্তু সেগুলোই একপর্যায়ে
ব্ল্যাকমেইলিংয়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকার একান্ত লাইভ ভিডিও চ্যাটিং
রেকর্ডও ছাড়া হয় পমপম লিংকে।
সিআইডি বলছে, এখন হাতে হাতে স্মার্টফোন। সহজলভ্য ইন্টারনেট। তাই বদ্ধঘরে সন্তানরা কী
করছেন, তা বোঝা অনেকটাই দুষ্কর। ‘পমপম’-এর ঘটনা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেমন: গোসলের
সময় এক তরুণী তার ছেলে বন্ধুকে ভিডিও কলে রাখেন। কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে গেলে সেই ভিডিও
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল জগৎ
কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা সন্তানকে জানাতে উদ্যোগ নিতে হবে পরিবার থেকে।
অহেতুক ছবি-ভিডিও নয় : যখন-তখন অহেতুক ছবি বা ভিডিও কতটা ভয়ংকর হতে পারে, এর
উদাহরণ মেলে বরিশালের এক মামলায়। এতে দেখা যায়, নিজের ঘরে ড্রেসি টেবিলের সামনে
তোলা ছবিতে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হন এক তরুণী। কিছুটা খোলামেলা ভঙ্গিতে তোলা ছবিগুলো
অজান্তেই গুগল ফটোতে আপলোড হয়ে যায়। পরে কৌশলে তা ডাউনলোড করেন তার দূর
সম্পর্কের এক আত্মীয়। এরপর ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়।
সিআইডি বলছে, স্মার্টফোনে যে কোনো অ্যাপ ডাউনলোডের আগে সতর্ক হতে হবে। কারণ,
ডাউনলোডের সময় বেশকিছু অ্যাপ ফোনের তথ্যভান্ডারে প্রবেশের অধিকার চায়। যেমন: ফেসবুক
চালু করতে গেলে মাইক্রোফোনে ঢোকার অনুমতি চায়। এক্ষেত্রে কেউ ‘হ্যাঁ’ অপশনে চাপ দিলে কথা
রেকর্ড করে ফেসবুক। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যা মোটেও নিরাপদ নয়।
সিআইডি জানায়, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারে দিনদিন সাইবার অপরাধও বাড়ছে। সিআইডির বিশেষ
হটলাইনে (০১৩২০০১০১৪৮) ৫০০-এর বেশি কল আসছে প্রতিদিন। এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত
ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে পড়া সংক্রান্ত। এছাড়া ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি
হ্যাকের অভিযোগ ভূরিভূরি।
পমপম-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক আতিকুর রহমান যুগান্তরকে
বলেন, সাইবারজগতে হাত বাড়ালেই বন্ধুত্ব। গেমিং, ফেসবুক আইডি হ্যাক বা অন্য কোনোভাবে
ভার্চুয়াল বন্ধু সেজে অনেকেই এগিয়ে আসে। অনেক সময় তাদের মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়।
এমনকি আবেগের বশে তারা একে অপরের সঙ্গে ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে। কিন্তু এমন
আবেগের চরম মাশুল দিতে হয়। তিনি বলেন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২-এর ৮/১ ধারা
অনুযায়ী, নিজ দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গের ভিডিও ধারণ এবং তা প্রকাশ করা গুরুতর অপরাধ।
এমনকি স্বামী বা স্ত্রী যদি একে অন্যের সম্মতিতেও দেহের নগ্ন ছবি বা ভিডিও ধারণ ও প্রকাশ
করেন, আইনের চোখে তা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত।
তথ্য সূত্র : অনলাইন থেকে সংগ্রহীত