মারিয়া, প্রথম বাংলাদেশি ‘আয়রন লেডি’ হওয়ার আগে যিনি কোনো দিন সমুদ্র দেখেননি

মারিয়া, প্রথম বাংলাদেশি ‘আয়রন লেডি’ হওয়ার আগে যিনি কোনো দিন সমুদ্র দেখেননি

একজন ডুব দিচ্ছেন সমুদ্রের তলদেশে, আরেকজন চলে যাচ্ছেন পাহাড়ে। দৌড়াচ্ছেন, সাঁতার কাটছেন,
সাইকেল চালাচ্ছেন মাইলের পর মাইল। আরেকজন গাড়ি হাঁকাচ্ছেন উচ্চগতিতে, অংশ নিচ্ছেন
দেশ–বিদেশের রেসে। নতুন প্রজন্মের এই তিন নারীই বাংলাদেশি। একজন স্কুবা ডাইভিং করছেন,

একজন জিতেছেন অর্ধদূরত্বের আয়রনম্যান, আরেকজন কার রেসিংয়ে অংশ নিচ্ছেন ভিনদেশের বড়
বড় আসরে। অদম্য এই নারীদের নিয়ে এবারের আয়োজন।
প্রথমবারের চেষ্টাতেই সফল হয়েছেন মারিয়া। আয়রনম্যান ৭০.৩–তে অংশ নিয়ে হয়েছেন দেশের
প্রথম নারী ট্রায়াথলেট।
১২ অক্টোবর মালয়েশিয়ার লাংকাউইতে অনুষ্ঠিত হয়েছে কঠিনতম ট্রায়াথলন (সাঁতার, সাইক্লিং ও
দৌড়ের সমন্বয়ে ক্রীড়া) আয়রনম্যানের দুই ফরম্যাটের প্রতিযোগিতা। এতে প্রথম বাংলাদেশি নারী
হিসেবে অংশ নিয়েছেন মারিয়া, যাঁর পোশাকি নাম মোছা. ফেরদৌসী আক্তার।
অর্ধদূরত্বের, অর্থাৎ আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সফল হয়েছেন মারিয়া। এই
নারী ট্রায়াথলেট ৮ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে সম্পন্ন করেছেন ১.৯ কিলোমিটার
সাঁতার, ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং ও ২১.১ কিলোমিটার দৌড়। আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার বৈশ্বিক
আয়োজক ওয়ার্ল্ড ট্রায়াথলন করপোরেশন (ডব্লিউটিসি)।
বছরজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। দেশের প্রথম
নারী হিসেবে মারিয়া শুধু আয়রনম্যান ৭০.৩ সম্পন্ন করেছেন তা নয়, এর মধ্য দিয়ে আগামী বছর
স্পেনে অনুষ্ঠেয় আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আয়রনম্যান ৭০.৩ শেষ করে ১৫ অক্টোবর ঢাকায় ফিরেছেন মারিয়া। ১৬ অক্টোবের বিকেলে প্রথম আলোর
কার্যালয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরে পুলিশ কর্মকর্তাকে পদক ও ট্রফি দেখালাম, তিনি
খুবই খুশি হলেন।’ এটা বলার কারণ আছে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাওয়ার সময় ৭ অক্টোবর মারিয়া বিমানবন্দরের
ইমিগ্রেশন পার হচ্ছিলেন, তখন এই কর্মকর্তাই অনেকক্ষণ ধরে তাঁকে জেরা করেছিলেন। কারণ এটাই ছিল, মারিয়ার
প্রথম বিদেশযাত্রা।
প্রথম আরও কিছু আছে মারিয়ার ঝুলিতে। তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কখনো সমুদ্রই দেখিনি। সেই আমি এবার
আয়রনম্যান ৭০.৩-তে এসে শুধু দেখলামই না, সমুদ্রে সাঁতার কাটতে হলো। আবার এর আগে কখনো পাহাড়ি পথে
সাইকেল চালাইনি। লাংকাউইতে সেটাও প্রথমবারের মতো করলাম।’
মারিয়া বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপির সাবেক ছাত্রী। ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। কিন্তু
এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি। কেন? ‘আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার জন্য। এটা আমার একটা স্বপ্ন ছিল। যেহেতু
বাংলাদেশের কোনো মেয়ে এতে আগে অংশ নেননি। তাই আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির জন্য এই বছরটা
বেছে নিয়েছি। ২০২৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব।’
বিকেএসপিতে মারিয়ার বিষয় ছিল ফুটবল। প্রিমিয়ার লিগ পর্যায়ে খেলেছেন বেশ কয়েকবার। ফেসবুক, ইউটিউবে
বাংলাদেশি আয়রনম্যান মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত, আরিফুর রহমানের ভিডিও দেখে এক দিনের কঠিনতম এই
ট্রায়াথলনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় মারিয়ার। ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু ম্যারাথনে অর্ধদূরত্বে
(২১.১ কিলোমিটার) অংশ নেন ও সফল হন। এরপর ৯–১০টা হাফ ম্যারাথনে অংশ নেন তিনি। এর মধ্যে ৭–৮টায় প্রথম
তিনটি স্থানের মধ্যে ছিলেন তিনি।
মারিয়া বলেন, ‘সাইক্লিং আগে থেকেই করতাম। হিরোর লাল সাইকেল দিয়ে শুরু। বাড়িতে আমার ৯টা সাইকেল আছে।
তবে সাঁতার পারতাম না।’ গত মার্চ মাসে সাঁতার শেখা শুরু করলেন ঢাকার গোলপুকুরে ও আফতাবনগরের চায়নিজ
প্রজেক্টের পুকুরে। শেখালেন ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম, সাঁতার প্রশিক্ষক মিজান ও
তৌফিক। মজার ব্যাপার হলো, আয়রনম্যান ৭০.৩ মালয়েশিয়ার জন্য নিবন্ধন করার পর তাঁর সাঁতার শেখার শুরু।

আয়রনম্যানে অংশ নিতে মারিয়াকে উৎসাহ দেন ট্রায়াথলেট ও চিকিৎসক সাকলায়েন রাসেল। রংপুরে তাঁদের আরএস
ফাউন্ডেশন থেকে পৃষ্ঠপোষকতাও করেন রাসেল। আরেকজন চিকিৎসক আবদুস সালাম মারিয়াকে বিভিন্ন কোম্পানির
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আর মারিয়ার ফুফাতো ভাই অনলাইন উদ্যোক্তা আখতারুল ইসলাম সব সময়ই তাঁকে
উৎসাহ দেন। বারাকা গ্রুপ ও সাইকেল ৩৬৫ মারিয়ার পৃষ্ঠপোষক ছিল এবার। মারিয়া বলেন, ‘আয়রনম্যানে খেলার
মতো সাইকেল তো আমার নেই। সাইকেল ৩৬৫ আমাকে একটি সাইকেল ধার দেয়, সেটা নিয়েই গিয়েছিলাম।’
মারিয়া আয়রনম্যান ৭০.৩ মালয়েশিয়ায় অংশ নেন ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স গ্রুপে। এই গ্রুপে তিনি দ্বিতীয় স্থান
অর্জন করেন। তিনি বলেন, ‘আরও ভালো করতে পারতাম। আমি দৌড়ের সময় ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেখানে ২৮
মিনিট নষ্ট হয়। আবার মালয়েশিয়া গিয়েই জ্বরে পড়েছিলাম। জ্বর নিয়েই রেস করেছি। সাকলায়েন ভাই, আরাফাত ভাই,
বেলাল ভাই আমাকে খুবই উৎসাহ দিয়েছেন প্রতিযোগিতার সময়। বলেছেন, “তুমি অনেক ছোট, মাথা ঠান্ডা রেখে শুধু
রেসটা শেষ করো। আমিও এটাকে প্রতিযোগিতা হিসেবে নিইনি। লক্ষ্য ছিল কমপ্লিট করা।”’
কঠিনতম এই ট্রায়াথলন সফলভাবেই সম্পন্ন করেছেন মারিয়া। ১৯ বছর ৮ মাস বয়সী এই তরুণী নিজের জীবনেও
আয়রনম্যানের মতো কঠিন কঠিন চ্যালঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে চলেছেন। রংপুরের পীরগঞ্জে জন্ম মারিয়ার।
বাবা মো. দবির উদ্দীনের পেশা কৃষিকাজ। মা রেহানা বেগম গৃহিণী। ৪ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় মারিয়া।
পীরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে রক্ষণশীল সমাজেই বেড়ে ওঠা মারিয়ার। কিন্তু খেলাধুলার প্রতি অদম্য আগ্রহ তাঁর।
বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষায় যখন টিকে যায় মেয়েটি, পরিবার থেকে বাধা এসেছিল, ‘আমি তখন বলেছিলাম, ভর্তি না
হলে পুলিশ এসে তোমাদের ধরে নিয়ে যাবে।’ মা–বাবা রাজি হলেন। বিকেএসপিতে এসে চুল ছোট (বয়কাট) করে ফেলেন
মারিয়া। পরিবার তখন বলেছিল, ‘তোমার তো বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই দুই ঈদেই শুধু বাড়িতে এসো।’ অন্যান্য ছুটিতে
তাই মারিয়া ঢাকায় এসে ফুফুর বাসায় থাকতেন।
এবারে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগেও মা–বাবাকে জানাননি মারিয়া, ‘জানালে আমার ছোট বোনের বিয়ে ভেঙে যাবে। তবে
আয়রনম্যান ৭০.৩ শেষ করার পর তাঁরা জেনেছেন।’ যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও অনেক দূর যেতে চান মারিয়া।
এখন তাঁর লক্ষ্য দুটি—এক. স্পেনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়া। আর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে
থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিক ট্রায়াথলনের বাছাইপর্বে অংশ নেওয়া। এটা অবশ্য বেশ কম দূরত্বের। তাই
আশাবাদী মারিয়া। বললেন, ‘বাংলা চ্যানেল, ইংলিশ চ্যানেল সাঁতার, আয়রনম্যান, অলিম্পিক—সবই করতে চাই আমি।’
তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *