শুধু মোহাম্মদপুর নয় ধানমন্ডিতেও একের পর এক ছিনতাই 

শুধু মোহাম্মদপুর নয় ধানমন্ডিতেও একের পর এক ছিনতাই 

জনবহুল এলাকায় অস্ত্র প্রদর্শন করে প্রকাশ্যে ঘটছে ছিনতাই। তা রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেই।
তখন মাত্র সন্ধ্যা। জনবহুল সাতমসজিদ রোডসংলগ্ন ধানমন্ডি ৮/এ সড়কের মাথায় হঠাৎ হেলমেট পরা চার ব্যক্তি জাপটে
ধরে রাসেল আলীকে। তিনি ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করলে হেলমেট পরা একজন ফাঁকা গুলি করে। আশপাশের লোকজন ভয়ে সরে যায়।
তখনো রাসেল আলী হাতে থাকা ব্যাগটি নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করছিলেন। আরেকটি গুলি করে দুর্বৃত্তরা, যা তাঁর কানের পাশ
দিয়ে যায়। এরপর ব্যাগটি কেড়ে নিয়ে চারজন চারটি মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে চলে যায়।
ঘটনাটি ঘটেছে ১৯ অক্টোবর। রাসেল আলী সাতমসজিদ সড়কে কেয়ারি প্লাজায় অবস্থিত বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান
ডেল্টা ব্যুরো ডি চেঞ্জের ব্যবস্থাপক। তাঁর ব্যাগে ছিল প্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা, যা ওই দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়।
ধানমন্ডিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার এটি একটি উদাহরণ। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওই এলাকায়
সন্ধ্যা নামলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ছিনতাই ও লুটের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। মোহাম্মদপুরে ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি এবং
অপরাধী চক্রগুলোর খুনোখুনি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; কিন্তু ধানমন্ডির ঘটনা সামনে আসছে না।
ফলে সেখানে অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যদিও মোহাম্মদপুর এলাকায়
গত শনিবার রাত থেকে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু হয়েছে। এ রাতে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানানো হয়েছে। 
৫০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের শিকার রাসেল আলীর ভাষ্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক তাঁর ভগ্নিপতি। রাসেল সন্ধ্যার পর ব্যবসার
টাকা তিনি বাসায় নিয়ে যান। ঘটনার দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার পথে ব্যক্তিগত কাজে কেয়ারি প্লাজার উল্টো
দিকের রাস্তায় যান। সেখানে হেলমেট পরিহিত চারজন লোক অস্ত্রের মুখে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। ওই দলের আরও চারজন
চারটি মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মোটরসাইকেলগুলোর কোনো নম্বর প্লেট ছিল না।
ছিনতাইয়ের এ ঘটনায় পরদিন (২০ অক্টোবর) ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানটির মালিক
কাইয়ুম রেজা। আট দিন পার হলেও ছিনতাইকারীদের কাউকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ। কাইয়ুম রেজা গতকাল রোববার প্রথম
আলোকে বলেন, পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করছে না। থানা থেকে বলা হচ্ছে, তাদের জনবলসংকট। তাদের এখন
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই। তারা কিছু করতে পারছে না।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক রায়হান সিদ্দিকী শামীম গতকাল  বলেন, তিনি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ
পর্যালোচনা করেছেন। তবে মামলার তেমন অগ্রগতি নেই।
গতকাল সরেজমিন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতমসজিদ রোডের ধানমন্ডি ৩/এ এলাকা থেকে শুরু করে
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন স্থানে মানুষ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছে। এর মধ্যে কোনো
কোনো স্থানে ওত পেতে থাকা অপরাধীরা, আবার সংঘবদ্ধ কিছু দল মোটরসাইকেল বা গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে থাকে।
ধানমন্ডিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার এটি একটি উদাহরণ। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওই এলাকায়
সন্ধ্যা নামলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ছিনতাই ও লুটের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
প্রকাশ্যে ছিনতাই, প্রতিকার নেই
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তখন ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গুলি চালানোকে
কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবন। সপ্তাহখানেক থানায় কোনো পুলিশ ছিল না।
পরে পুলিশ ফিরলেও কার্যক্রম সীমিত। এ সুযোগে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া
যাচ্ছে। যদিও ঢাকা মহানগরে বিভিন্ন অপরাধে কত মামলা হয়েছে, সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই
মামলা করতে থানায় যাচ্ছেন না। কেউ কেউ থানায় গেলেও পুলিশ মামলা নিতে চায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ধানমন্ডির ৮/১ নম্বর সড়কে কাকলি স্কুলের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে
রাইয়ান ভূঁইয়া নামের এক শিক্ষার্থী। ওই দিনই ধানমন্ডি থানায় লিখিত অভিযোগ দেন রাইয়ানের মা তাজনুর জাহান; কিন্তু সেটি
থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়নি।
তাজনুর জাহান বলেন, তিনি থানায় যাওয়ার পর পুলিশ যেভাবে বলেছে, সেভাবেই অভিযোগ দিয়েছেন। পুলিশ এ ঘটনায় কোনো
পদক্ষেপ নেয়নি। এ ঘটনার আইনি প্রতিকার পেতে তিনি থানায় দুবার গিয়েছিলেন। পুলিশকে বারবার বলা হয়েছে, ঘটনাস্থল ও
আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ যেন দেখা হয়। পুলিশ সেটিও করেনি।
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর পদচারী–সেতুসংলগ্ন একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন,
সাত–আট দিন আগে সন্ধ্যার পর এক ব্যক্তি পদচারী–সেতু পার হতেই তিন ছিনতাইকারী ছুরি ও রামদা দেখিয়ে তাঁর মুঠোফোন ও
ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। জায়গাটিতে গত দুই মাসে আরও অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে দেখেছেন তিনি।
তবে পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জিসানুল হক দাবি করেন, কোনো ভুক্তভোগী থানায় এলে
প্রতিকার না পাওয়ার সুযোগ নেই।
গত শনিবার সন্ধ্যার পরপর মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তাসরীন শামীমা। তিনি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি প্রকাশ করেছেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘আজ (শনিবার) সন্ধ্যায় এমবিএর ক্লাস শেষ করে
ক্যাম্পাস থেকে রিকশা করে বাসায় (মোহাম্মদপুরে) ফিরছিলাম। সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার দিকে ৩২–এর কাছাকাছি মিরপুর রোড
সিগন্যালে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি। দুজন ছিনতাইকারী রিকশায় বসে থাকা একটা মেয়ের ওপর হামলা চালায়। রাস্তায় জ্যামে
এত মানুষ ছিল, কেউ বাঁচাতে আসেনি! যাই হউক আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। মোবাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া
করলেও আমার চিৎকার–চেঁচামেচিতে শেষ পর্যন্ত ওরা হাল ছেড়ে পালিয়ে যায়।’
তাসরীন  বলেন, এ ঘটনার পর তিনি বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ও আশপাশের এলাকায়
প্রতিনিয়ত মানুষ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে বলে শুনতে পারছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানমন্ডি থানাধীন মিরপুর সড়কের ৩২ নম্বর থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের
পদচারী–সেতু (ফুট ওভারব্রিজ) পর্যন্ত এলাকাটি আগে থেকেই ছিনতাইপ্রবণ হিসেবে পরিচিত ছিল। আগে সাধারণত ভোরে ফাঁকা
সড়কে ‘টানা পার্টির’ সদস্যরা এ সড়কে সক্রিয় ছিল। এখন সন্ধ্যার পর সড়কটিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারাল অস্ত্র প্রদর্শন
করে দলবদ্ধ ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্যে ছিনতাই করছে। তারা ছিনতাইয়ের পর মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার অথবা ছোট ট্রাকে
(পিকআপে) উঠে পালিয়ে যাচ্ছে।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর পদচারী–সেতুসংলগ্ন একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন,
সাত–আট দিন আগে সন্ধ্যার পর এক ব্যক্তি পদচারী–সেতু পার হতেই তিন ছিনতাইকারী ছুরি ও রামদা দেখিয়ে তাঁর মুঠোফোন ও
ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। জায়গাটিতে গত দুই মাসে আরও অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে দেখেছেন তিনি।
এডিসি জিসানুল হক বলেন, এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে। তাঁর দাবি, ধানমন্ডি এলাকায় ছিনতাই কম। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে
ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
অভিযানে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে গতকাল
সকালে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ছিনতাইপ্রবণ ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসানো হয় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প
র পক্ষ থেকে অভিযানের কথা বলা হলেও ছিনতাই ও ডাকাতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নগরবাসীর মধ্যে। অনেকে মনে করেন,
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি বসালে পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণে আসত।
ধানমন্ডির বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আতঙ্কে আছি। এভাবে চলতে পারে না। আমরা
চাই, সরকার এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিক।’
তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *